“গণঅভ্যুত্থান থেকে রাজনীতির মূলধারা: নারী নেতৃত্ব কি শুধুই প্রতীকী?”

শুহরাত রানা রুশমী | 31 July 2025
No image

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নারীর অংশগ্রহণ কখনোই নিছক একজন দর্শকের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম থেকে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান—প্রতিটি পর্যায়ে নারীরা ছিলেন সংগ্রামের ফ্রন্টলাইনে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন ছিল তার সর্বশেষ প্রমাণ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসা নারী শিক্ষার্থী, কর্মজীবী নারী, গৃহিণী, এমনকি প্রথমবার রাজনীতিতে সরব হওয়া তরুণীরাও রাস্তায় ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে, সক্রিয় পদক্ষেপে।এই উপস্থিতি শুধু একটি আন্দোলন নয়, বরং নারী রাজনীতির ভবিষ্যতের এক সাহসী সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সম্ভাবনা কি রাজনীতির মূলধারায় কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে?  আন্দোলন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলো, সংস্কার কমিশন গঠিত হলো, নতুন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। কিন্তু কোথাও নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ল না। নতুন সম্ভাবনার যে রাজনীতি গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা নারী নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণের জায়গায় পুরনো ব্যর্থতাই পুনরাবৃত্তি করলো।

বাংলাদেশে প্রায় চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে নারী রয়েছেন। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও রওশন এরশাদ—তিনজনই দলের সর্বোচ্চ পদে থেকে দেশ পরিচালনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু এই নেতৃত্ব কি নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের প্রতিচ্ছবি?বাস্তবতা হলো, এই নেতৃত্ব ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। একে অনেকেই ‘প্রতীকী নারী নেতৃত্ব’ বলে অভিহিত করেন। কারণ, দলের ভেতরে বা নিচতলার রাজনীতিতে নারীর বাস্তবিক অবস্থান এখনো দুর্বল। কোনো রাজনৈতিক দলই ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি, যদিও সেটি নির্বাচন কমিশনের বাধ্যতামূলক শর্ত। এমনকি নারী নেতৃত্বের পেছনেও প্রভাবশালী পারিবারিক পরিচয় বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বড় ভূমিকা রাখছে, যোগ্যতা নয়।রাজনৈতিকদলের অনেক কমিটিতে নারীদের জায়গা দেওয়া হয় পরিবারের সদস্যদের অগ্রাধিকার দিয়ে, তৃণমূল থেকে উঠে আসা নারীদের দিয়ে নয়। এই ধারা পরিবর্তন না হলে রাজনীতির কাঠামোতে নারী শুধু নামমাত্র উপস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের প্রশ্নে কোটা ব্যবস্থা বহুদিন ধরেই বিতর্কিত। একপক্ষ মনে করে, কোটা ব্যবস্থা ছাড়া নারীরা রাজনীতির মূলধারায় প্রবেশ করতে পারবেন না, কারণ দেশের রাজনৈতিক কাঠামো নারীবান্ধব নয়—বরং বহুস্তরীয়ভাবে তাদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গঠন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, মাঠপর্যায়ের রাজনীতির পরিবেশ—সবকিছু এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে নারীদের প্রবেশ ও টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন। অন্যপক্ষ বলছে, কোটা থাকার ফলে রাজনীতিতে অনেক সময় অযোগ্য, পরিবারের ঘনিষ্ঠ বা অনুগত নারীদের স্থান দেওয়া হয়, যোগ্যদের নয়।এই বিতর্কের মধ্যেও একটি সত্য পরিষ্কার বাংলাদেশের সমাজ এখনো এমন অবস্থায় নেই যেখানে শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর যে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা প্রবল, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ ‘স্বাভাবিক’ নয় বলেই মনে করা হয়। ফলে কোটার প্রয়োজনীয়তা এখনো অস্বীকার করার মতো অবস্থানে আসেনি।বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের ভিতরে সংস্কার, যেখানে নারীর পদপ্রাপ্তি কেবল সংখ্যা নয়, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবিক ক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি প্রতিফলিত হবে।

নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণে সবচেয়ে বড় কাঠামোগত বাধা হলো নিরাপত্তাহীনতা। আন্দোলনের সময় যারা রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের অনেকেই আন্দোলন-পরবর্তী সহিংসতা, হয়রানি, এমনকি সামাজিক মোরাল পুলিশিংয়ের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় নারীদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, পোশাক, কিংবা প্রকাশ্যে ধূমপান—এসব নিয়ে যে নৈতিক সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, তা শুধু তাদের সামাজিক অবস্থান নয়, রাজনৈতিক সক্ষমতাকেও সংকুচিত করেছে।এই পরিস্থিতিতে নারীর জন্য রাজনীতি একটি নিরাপদ ক্ষেত্র নয়—এটিই এক ভয়াবহ বাস্তবতা। পুরুষ ও নারী উভয় নেতাই সামাজিক মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন, তবে নারী নেত্রীরা তুলনামূলকভাবে বেশি লক্ষ্যবস্তু হন। যেখানে পুরুষ নেতাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রায়শই রাজনৈতিক বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেখানে নারী নেত্রীদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আক্রমণ, চরিত্রহনন এবং যৌন বিভেদমূলক মন্তব্যের প্রবণতা অনেক বেশি।এই কাঠামোগত অসাম্য শুধু সমাজ বা জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ নীতিতেও তা প্রতিফলিত হয়। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই এখনো পর্যন্ত কোনো নারীবান্ধব নীতিমালা নেই, এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দেখা যায় না। ফলে নারীদের জন্য রাজনৈতিক দলে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া বা নেতৃত্বে আসা শুধু মাত্র চ্যালেঞ্জিং নয়, বরং অনেক সময় অপমানজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে এই অবস্থার পরিবর্তনে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজস্ব কাঠামোর ভেতর থেকে টক্সিক পুরুষতন্ত্রের চর্চাকে চিহ্নিত করা ও তা থেকে সরে আসা। রাজনীতি যদি সমতার চর্চার জায়গা হয়, তাহলে নারীর জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়—এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য শর্ত। নারীদের রাজনৈতিক পরিসরে কাজ করার পরিবেশ যদি সম্মানজনক না হয়, তাহলে নেতৃত্বের পথ তারা কতদূর এগুতে পারবেন?

রাজনীতি কি নারীর জন্য? এই প্রশ্নটি এখন জরুরি। কেননা, রাষ্ট্র যখন নানা সংস্কারের পথে এগোচ্ছে, সেখানে নারীর অবস্থান কেমন হবে—তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। সাম্প্রতিক সংস্কার কমিশনগুলো সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক দলের ভিতরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে কোনো সুপারিশ করেনি। এতে করে একটি ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে—যেখানে একদিকে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে দলগতভাবে নারীর প্রবেশদ্বার সংকুচিত রাখা হচ্ছে।যদি রাজনীতি সত্যিই জনগণের জন্য হয়, তাহলে সেই রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ হতে হবে সম্মানজনক, কার্যকর ও নিরাপদ। শুধু নির্বাচনী প্রচারে নারী নেত্রীর ‘মুখ’ ব্যবহার করলে বা কোটার অজুহাতে দলে কয়েকজন নারী রাখলেই তা সমতা নিশ্চিত করে না। সমতা নিশ্চিত হয় যখন নারীরা দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন।

সব নেতিবাচক বাস্তবতার মাঝেও একটি বিষয় স্পষ্ট—নারীরা থেমে নেই। প্রতিবারের মতো এবারও তারা রাস্তায় নেমেছেন, নিজেদের উপস্থিতি এবং শক্তি দেখিয়েছেন। এই সাহসিকতা প্রমাণ করে, তারা রাজনৈতিক অধিকার এবং নেতৃত্বের দাবিতে আর পেছনে ফেরার মানুষ নন।এখন দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে নীতিগত ও সাংগঠনিক সংস্কার, নারীর জন্য নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং তরুণ নারীদের রাজনীতিতে উৎসাহিত করা।সমাজকে বুঝতে হবে, রাজনীতি নারী বা পুরুষের একক ক্ষেত্র নয়—এটি নাগরিকতার বহুমাত্রিক প্রকাশ। আর নাগরিকত্বের সেই প্রকাশে নারীকে শুধুমাত্র ‘প্রতিনিধিত্ব’ নয়, ‘ক্ষমতা’ দিতে হবে।সময় এসেছে নারী নেতৃত্বের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির পর্দা সরিয়ে দেওয়ার। নারীকে প্রতীক নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর সক্রিয়ভাবে যুক্ত হবার একটি বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে এবার। এই সম্ভাবনাকে অবশ্যই বাস্তবে পরিণত করতে হবে। 

Shurat Rana Rushmi is a Research Associate at the Centre for Governance Studies. This blog was published as a part of the ongoing collaborative partnership project between the Embassy of the Kingdom of the Netherlands and the CGS under the project “Women and Youth Engagement in Politics in a Post-Uprising Bangladesh.”  

Disclaimer: Views in this article are author’s own and do not necessarily reflect CGS policy



Comments